আবুল কাসিম ইবনু জুজাই কালবি

ইমাম আবুল কাসিম ইবনু জুজাই কালবি 

লেখকের নাম—মুহাম্মাদ ইবনু আহমাদ ইবনি মুহাম্মাদ ইবনি জুজাই কালবি। উপনাম—আবুল কাসিম।

৬৯৩ হিজরি। ইসলামি খিলাফাহর গ্রানাডা শহর। এখানেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন কালের অক্ষরে স্বমহিমায় নিজের নাম উৎকীর্ণ করে যাওয়া এই মহান মনীষী। বংশীয় মর্যাদায় ছিলেন সম্ভ্রান্ত, অভিজাত। নিরবচ্ছিন্ন অধ্যয়নে ছিলেন প্রবাদতুল্য। রচনা, সংকলন আর জ্ঞান-গবেষণায় ছিলেন একেবারে আত্মমগ্ন।

তিনি ছিলেন বিখ্যাত ফকিহ, হাফিজ ও অধ্যাপক। সমান পারদর্শ ছিলেন একাধারে আরবি ভাষা-সাহিত্য, আকিদা, ইলমুল কিরাআত ও হাদিসশাস্ত্রে। কুরআন কারিম ব্যাখ্যাসহ ছিল তার আগাগোড়া মুখস্থ। ইমামগণের মতামতসমূহ ছিল নখদর্পণে। আত্মস্থ ছিল অসংখ্য কিতাব। যে কোনো মজলিসে তিনিই হতেন মধ্যমণি। শ্রোতারা তার আলোচনায় হতো মন্ত্রমুগ্ধ। আর হৃদয়—সে তো ছিল স্ফটিক-স্বচ্ছ।

ইমাম আবুল কাসিম অল্প বয়সেই খতিব হয়েছিলেন। নিজ শহরে শাহি মসজিদের খতিবের পদ তিনি খুব অল্প বয়েসেই অলঙ্কৃত করেছিলেন। মানুষ তার জ্ঞানসৌন্দর্য দুচোখ ভরে অবলোকন করত। বংশীয় পরিপাট্য, আভিজাত্য আর সম্মান—পূর্ণ দক্ষতার সাথেই তিনি সামলাতেন।

শিক্ষাজীবন

তিনি উসতাজ আবু জাফর ইবনু জুবাইর (মৃত্যু : ৭০৮ হিজরি) এবং আবু আবদিল্লাহ ইবনু কাম্মাদ (মৃত্যু : ৭১২ হিজরি) থেকে আরবি ভাষা, ফিকহ, হাদিস ও কুরআন কারিমের জ্ঞান লাভ করেন।

বিদগ্ধ খতিব আবু আবদিল্লাহ ইবনি রুশাইদ (মৃত্যু : ৭২১ হিজরি) আবুল মাজদ ইবনু আহওয়াস, কাজি আবু আবদিল্লাহ ইবনি বুরতাল এবং গবেষক কাসিম ইবনু আবদিল্লাহ ইবনি শাত-সহ প্রথিতযশা অনেক জ্ঞানসমুদ্রের সুদীর্ঘ সংস্পর্শে ধন্য হয়েছেন।

অসংখ্য বিদ্বান তার শিষ্যত্ব অর্জন করেছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম—লিসানুদ্দিন ইবনু খতিব (মৃত্যু : ৭৭৬ হিজরি) মুহাম্মাদ ইবনু মুহাম্মাদ আনসারি—যিনি ইবনু খাশশাব নামে প্রসিদ্ধ (মৃত্যু : ৭৭৪ হিজরি) আবু আব্দুল্লাহ শুদাইদ (মৃত্যু : ৭৭৬ হিজরি) এবং লেখকের তিন সন্তান—আবু আবদিল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনি মুহাম্মাদ কাতিব (মৃত্যু : ৭৫৭ হিজরি) আবু বকর আহমাদ ইবনি মুহাম্মাদ কাজি (মৃত্যু : ৭৮৫ হিজরি) আবু মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ ইবনি মুহাম্মাদ।

রচনাবলি

বিভিন্ন শাস্ত্রে তিনি অনেকগুলো কিতাব রচনা করেছেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য—

  • ০১. আত-তাসহিল লি উলুমিত তানযিল—কুরআন কারিমের তাফসির।
  • ০২. ওয়াসিলাতুল মুসলিম ফি তাহজিবি সহিহ মুসলিম।
  • ০৩. আল-আনওয়ারুস সানিয়া ফিল আলফাজিস সুন্যিয়া।
  • ০৪. আদ-দাওয়াত ওয়াল আজকার- বিশুদ্ধ হাদিস থেকে সংগৃহীত দুআ ও জিকির।
  • ০৫. আল-কাওয়ানিন আল-ফিকহিয়া—মালিকি মাজহাবের সংক্ষেপণের পাশাপাশি শাফিয়ি, হানাফি ও হামবলি মাজহাবের বর্ণনা।
  • ০৬. তাকরিবুল উসুল ইলা ইলমিল উসুল।
  • ০৭. আন নুরুল মুবিন ফি কাওয়ায়িদি আকায়িদিদ দ্বীন—বক্ষ্যমাণ কিতাব।
  • ০৮. আল মুখতাসারুল বারি’ ফি কিরাআতি নাফি।
  • ০৯. উসুলুল কুররা আস-সিত্তাহ গাইরু নাফি।
  • ১০. আল ফাওয়াইদুল আম্মাহ ফি লাহনিল আম্মাহ।

তিনি কবিতাও লিখতেন। তার উল্লেখযোগ্য কবিতাংশ—

لكل بني الدنيا مراد ومقصد … وإن مرادي صحة وفراغ

لأبلغ في علم الشريعة مبلغا … يكون به لي في الجنان بلاغ

ففي مثل هذا فلينافس أولو … النهى وحسبي من الدنيا الغرور بلاغ

فما الفوز إلا في نعيم مؤبد … به العيش رغد والشراب يساغ

কামনা-বাসনা দুনিয়াতে সবারই থাকে কিছু; আমার আকাঙ্ক্ষা—সুস্থতা ও অবসর..

শরিয়াহর সর্বোচ্চ জ্ঞানস্তরে পৌঁছতে পারি যেন; জান্নাতে যাওয়ার জন্য যা পূঁজি হবে আমার..

এ-কাজে জ্ঞানীরা তো করবেই প্রতিযোগিতা; তাছাড়া কালের দুর্বিপাকে না পড়ে, ধোঁকাবাজ দুনিয়া থেকে জীবনধারণ পরিমাণটুকুই যথেষ্ট আমার..

সফলতা—সে তো জান্নাতেই; সেখানেই সুখময় জীবন, শরাব-মদিরার আনন্দ আসর, আর চিরস্থায়ী নিশ্চয়তা..

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রশংসায় তিনি রচনা করেন—

أروم امتداح المصطفى فيردني *** قصوريَ عن إدراك تلك المنـاقـبِ
ومن لي بحَصْر البحرِ والبحرُ زاخر *** ومن لي بإحصاء الحصى والكواكبِ
ولو أن أعضائي غدت ألسنا إذن *** لما بلغت فـي المدح بعض مـآربِ
ولو أن كل العالمين تسـابقــوا *** إلى مدحه لم يبلغوا بعض واجــبِ
فأمسكت عنه هيبـة وتـأدبـاً *** وعـجزا وإعظاماً لأرفع جانــبِ
ورب سكوت كان فيه بـلاغـةٌ *** ورب كلام فيه عتب لعــاتــبِ

আমি প্রিয় নবীর প্রশংসাবাণী রচনা করতে চাই, কিন্তু অক্ষমতা আমাকে সে মর্যাদার নাগাল পেতে বাধাগ্রস্ত করে।

আমার কী সামর্থ্য আছে; আমি সমুদ্র পরিবেষ্টন করব—যে সমুদ্র টইটম্বুর?

আমায় কে সাহায্য করবে তারকারাজি আর কঙ্করমালা গণনা করতে?

আমার সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যদি জিহ্বার ন্যায় কথা বলতে শুরু করে, তবুও তার প্রশংসার কিঞ্চিৎ পরিমানও আমি শেষ করতে পারব না।

যদি সমগ্র বিশ্বজগত তাঁর প্রশংসায় কিতাব রচনা করে তবুও জরুরি সামান্য পরিমানও পূর্ণ করতে পারবে না।

ফলে আমি ভয়ে ও আদব রক্ষার্থে, আশংকা ও শ্রদ্ধার্থে নিরবতা অবলম্বন করেছি।

কেননা, অনেক সময় নিরবতাতেও পূর্ণ অভিব্যক্তি প্রকাশ পায়; আবার কথাতে থাকে তিরস্কার।’

 

ইনতিকাল

৭৪১ হিজরি। তারিফের ঘটনায়[1] আবুল কাসিম ইবনু জুজাই কালবি রাহিমাহুল্লাহ শাহাদতবরণ করেন । নাইলুল ইবতিহাজ গ্রন্থে তুনবুকতি বর্ণনা করেন—‘হাজরামি থেকে : আমাদের উস্তাদ বিচিত্র জ্ঞানের আধার ইবনু জুজাই তারিফের ঘটনায় শাহাদত বরণ করেন।’

আবু বকর ইবনু জিলওজারাতাইন বলেন—তারিফের দিন তিনি সর্বশেষ নিম্নের কবিতাটি আবৃত্তি করেন :

‘জীবনের শুরু-শেষে, কত আশা মানুষের, আমি তো নই সেই লোক;—আমার ভেতর ও বাহির, আমার সকল নিবেদনে, একটাই চাওয়া ছিল—হে আমার ইলাহ, হে প্রিয়তম..

এক নিতান্ত বাস্তবতায়, এক পরিশুদ্ধ দিলে, এক প্রশান্ত সময় বা মুহূর্তে..আপনার রাস্তায় শাহাদাত চাই..।

এক এমন রক্তাক্ত শরীর চাই, জীবনের যাবতীয় পাপ যা ধুয়ে দেবে শরীর থেকে..

রক্তের যে ধারা নিভিয়ে দেবে আপনার প্রজ্জ্বলিত ক্রোধের আগুন..মুক্তির গান গেয়ে শোনাবে আমায়..

আর, হে প্রভু প্রিয়তম, সে তো কেবল কাফিরের তরবারির আঘাতেই হতে পারে শুধু..। আপনি তা করে নেন কবুল প্রিয়তম..’

অতঃপর তিনি বলেন—‘আমি আশা করি, আজই আমার মনোবাসনা পূর্ণ হবে—যা আমি এই কবিতার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার কাছে চেয়েছি।’

আর সত্যি, মহান আল্লাহ তাআলা তার দুআ কবুল করেছিলেন। আল্লাহ তার মাকবারাকে নুর দিয়ে ভরে রাখেন। স্থায়ী শান্তি ও নিরাপত্তায় ছেয়ে রাখেন। আমিন।

[1] ৭৪১ হিজরির জুমাদাল উলা মাস। জিব্রালটার প্রণালীর কাছে তৎকালীন উন্দুলুসের মুসলিম ও খ্রিস্টানদের মধ্য এই যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিল। যে ‍যুদ্ধে মুসলিমদের পরাজয় ঘটেছিল। এটা স্পেনের বড়ো যুদ্ধগুলোর মধ্যে সর্বশেষ যুদ্ধ ছিল।